মাইলস্টোনের বাতাসে এখনো লেগে আছে পোড়া গন্ধ; নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে ছেঁড়া বই, খাতা আর শিশুর স্কুলব্যাগ।
দুর্ঘটনার দ্বিতীয় দিনেও ভিড় কৌতূহলী মানুষের, ক্যাম্পাসজুড়ে ছবি তোলার হিড়িক।
পানিতে ভেজা, আধা ছেঁড়া একটি খাতা—ইংরেজিতে লেখা নাম ‘রাইসা মনি’, তৃতীয় শ্রেণি, কোড ২০১০, সেকশন আকাশ।
রাইসা মনির সেই খাতা আর আধপোড়া স্কুল ব্যাগটি পড়ে ছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনের এক কোণায়।
বিমান বাহিনীর একটি জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ভবনটির একাংশ ধসে পড়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে কংক্রিটের জঞ্জাল।
দুর্ঘটনাস্থলে এখনো ভাসছে পোড়া গন্ধ। মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাচ্চাদের বই-খাতা, আধপোড়া ব্যাগ আর দগ্ধ চেয়ার—সবই যেন ভয়াবহতার নীরব সাক্ষী।
২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তৃতীয় শ্রেণির রাইসা মনির কোনো খোঁজ মেলেনি। স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাকে।
রাইসা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বাজড়া গ্রামের শাহাবুল শেখের মেয়ে। শাহাবুল ঢাকার মিরপুরে ব্যবসা করেন।
মেয়ের খোঁজ না পেয়ে মঙ্গলবার সকালে আবার স্কুলে ছুটে আসেন রাইসার মা রাবেয়া খাতুন মিম। তার ভাই হায়দার আলী ভবনের পাশে আবর্জনার স্তূপে খুঁজে পান রাইসার ভেজা খাতা আর আধপোড়া স্কুল ব্যাগ।
সোমবার দুপুরে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, স্কুলের মাঠে বিধ্বস্ত হওয়ার পর যুদ্ধবিমানটি ছেঁচড়ে গিয়ে সোজা ধাক্কা খায় দুইতলা হায়দার আলী ভবনে। মুহূর্তেই অগ্নিগোলকে পরিণত হওয়া বিমানটির শিখা গ্রাস করে নেয় পুরো ভবন।
তখন স্কুল ছুটির সময়, ভবনের আশেপাশে ভিড় করেছিলেন অনেক অভিভাবকও। দুর্ঘটনার পর ভবনের প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক—কেউই বের হতে পারেননি।
উদ্ধার অভিযান শেষে জঙ্গি বিমানের পাইলটসহ ১৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ভবন থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় আরও ১৭১ জনকে—তাদের বেশিরভাগই শিশু এবং মারাত্মকভাবে দগ্ধ।
রাতের মধ্যে আহতদের মধ্যে আরও ১০ জন হাসপাতালে মারা গেলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ জনে। এখনও ৭৮ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, যাদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
নিহতদের মধ্যে ২০ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু ছয়টি মরদেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
তাদের মধ্যে কি রাইসা আছে? তা জানতে এখন একমাত্র উপায় ডিএনএ পরীক্ষা।
রাইসার মায়ের মতো আরও অনেক অভিভাবক মঙ্গলবার সকাল থেকে স্কুলের পোড়া ভবনের বাইরে ভিড় জমিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তাসলিমা আক্তার নামে এক অভিভাবক বলেন, “শিক্ষার্থীদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। কাল সারারাত চোখের পানি ফেলেছি, যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভোর হতেই আবার ছুটে এসেছি। আমরা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত আর বিচার চাই।”
দুর্ঘটনার দ্বিতীয় দিনেও স্কুল ক্যাম্পাসে কৌতূহলী জনতার ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই হুড়োহুড়ি করে ছবি তুলছিলেন, কেউ কেউ ভিডিও করছিলেন।
দুর্ঘটনাস্থলের কাছে মোতায়েন রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। হায়দার আলী ভবনটি ঘিরে রাখা হয়েছে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা হলুদ টেপ দিয়ে। সিআইডির ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছে।
সকাল থেকেই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থল সংলগ্ন এলাকায় বিক্ষোভ করছেন। নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণসহ ছয় দফা দাবি তুলেছেন তারা।
বেলা পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। প্রায় অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে তিনি শিক্ষার্থীদের সব দাবি ‘যৌক্তিক’ বলে স্বীকার করে নেন।
মাইলস্টোনের মর্মান্তিক ঘটনার শোক বয়ে মঙ্গলবার সারাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছে বাংলাদেশ।
সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশেষ প্রার্থনা।
0 Comments